কাজী নজরুল ইসলাম: বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী ও সাম্যের কবি

 

Literature of Kazi Nazrul Islam
ছবিঃ সংগৃহীত।

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) ছিলেন এক বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগীতজ্ঞ, এবং সমাজসংস্কারক ছিলেন। তার লেখনীতে বিদ্রোহ, প্রেম, সাম্যবাদ এবং মানবতার গভীর চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। ‘বিদ্রোহী কবি’ নামে পরিচিত নজরুল বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা করেন।

কাজী নজরুল ইসলামের জীবন

কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। শৈশবেই পিতৃহীন হওয়ায় তিনি কঠিন জীবনসংগ্রামে লিপ্ত হন। বিভিন্ন সময়ে মসজিদে মুয়াজ্জিন, লেটো গানের দলে অংশগ্রহণ, রুটির দোকানে কাজ করার মতো বিভিন্ন পেশায় যুক্ত ছিলেন।

সাহিত্যকর্ম ও প্রভাব

নজরুলের সাহিত্য বহুমুখী। তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান, প্রবন্ধসহ বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন। তার সাহিত্যকর্মে প্রধানত বিদ্রোহ, সাম্যবাদ, মানবতা, প্রেম ও প্রকৃতির ছোঁয়া দেখা যায়।

বিদ্রোহী কবি

১৯২২ সালে প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুলকে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত করে তোলে। এই কবিতায় তিনি অত্যাচারী ও শোষকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা তুলে ধরেন:

“বল বীর, বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি, নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!”

সাম্যবাদ ও সমাজচিন্তা

নজরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মে সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের ছাপ স্পষ্ট। তার ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় তিনি সকল মানুষকে সমান বলে ঘোষণা করেন। এছাড়াও ‘মানুষ’ কবিতায় তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে সবচেয়ে বড় পরিচয় হিসেবে তুলে ধরেন।

প্রেম ও রোমান্টিকতা

নজরুলের প্রেমের কবিতা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। ‘সন্ধ্যা’, ‘সিন্ধু হিন্দোল’, ‘চোখের চাওয়া’ প্রভৃতি কবিতায় তার প্রেমের গভীরতা ফুটে ওঠে। তার রচিত অনেক গানও প্রেম ও বিরহের চিরায়ত আবেদন বহন করে।

ধর্ম ও দর্শন

নজরুল হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় তিনি লিখেছেন—“আমরা হিন্দু না মুসলমান, আমরা মানুষ!” তার ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ এবং ‘জাগো দুর্গা’ গান দুটি যথাক্রমে ইসলামিক ও হিন্দু ধর্মের প্রতি তার শ্রদ্ধার প্রতিফলন।

সাংগীতিক অবদান

বাংলা সংগীতে নজরুল এক বিশেষ ধারার প্রবর্তন করেন, যা ‘নজরুলগীতি’ নামে পরিচিত। তিনি প্রায় ৪০০০-এর বেশি গান রচনা করেছেন, যা আজও সমান জনপ্রিয়। তার গানে প্রেম, বিদ্রোহ, ভক্তি, প্রকৃতি ও জীবনসংগ্রামের অনবদ্য ছোঁয়া রয়েছে।

সাংবাদিকতা ও সম্পাদনা

নজরুল সাংবাদিক হিসেবেও সক্রিয় ছিলেন। তিনি ‘ধূমকেতু’, ‘নবযুগ’, এবং ‘লাঙল’ পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন। ‘ধূমকেতু’তে প্রকাশিত তার বিভিন্ন প্রবন্ধ ব্রিটিশ শাসকের রোষের কারণ হয় এবং তাকে কারাবরণ করতে হয়।

কারাবাস ও সংগ্রাম

১৯২৩ সালে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত ব্রিটিশবিরোধী লেখার কারণে নজরুল কারাবরণ করেন। জেলে থেকেও তিনি ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ ও ‘জিঞ্জির’ কবিতা লেখেন, যা ব্রিটিশবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে।

অসুস্থতা ও পরবর্তী জীবন

১৯৪২ সালে তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন, যা তার বাকশক্তি কেড়ে নেয়। এরপর দীর্ঘ ৩৪ বছর তিনি নির্বাক জীবন কাটান। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে ঢাকায় এনে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি আজও অনুপ্রেরণার উৎস। তার সাহিত্য, সংগীত, সাংবাদিকতা এবং সমাজ সংস্কারমূলক কাজ চিরকাল বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মনে বেঁচে থাকবে। তার বিদ্রোহ, সাম্যবাদ, প্রেম ও মানবতার বাণী চিরকাল প্রজন্মের পর প্রজন্মকে পথ দেখাবে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url