মহাকাশে সুনিতাদের ৯ মাস- কর্মলিপি
প্রায় নয় মাস মহাকাশে থাকার পর অবশেষে পৃথিবীতে ফিরেছেন নভোচারী বুচ উইলমোর ও সুনিতা উইলিয়ামস। মঙ্গলবার রাত ৩টা ৫৭ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা উপকূল থেকে ৫০ মাইল দূরে সমুদ্রে অবতরণ করে তাদের বহনকারী ক্যাপসুল।
মহাকাশে অতিরিক্ত সময়, কিন্তু কর্মব্যস্ত জীবন
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে (আইএসএস) নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় কাটাতে হলেও তারা সময় নষ্ট করেননি। ৪০০ কিলোমিটার ওপরে ভেসে থেকে তারা মহাকাশ গবেষণা, রক্ষণাবেক্ষণ, মহাকাশে হাঁটা (স্পেসওয়াক), ভোট প্রদান, ক্রিসমাস উদযাপন এবং শূন্য অভিকর্ষে শরীরচর্চার মতো কাজ করেছেন।
৫৯ বছর বয়সী সুনিতা ও ৬২ বছর বয়সী বুচ দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা ও স্টেশনের রক্ষণাবেক্ষণে ব্যস্ত ছিলেন। তারা স্টেশনের অভিমুখ নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রপাতি মেরামত, নিক্সার এক্স-রে টেলিস্কোপের জন্য আলোক ফিল্টার সংযোজন এবং একটি আন্তর্জাতিক ডকিং অ্যাডাপ্টারে প্রতিফলক ডিভাইস প্রতিস্থাপন করেছেন।
পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে নতুন ভাবনা
নভোচারীরা প্রতিদিন ১৬ বার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ পান, কারণ আইএসএস প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ১৬ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। এই অভিজ্ঞতা তাদের পৃথিবী সম্পর্কে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে।
সুনিতা বলেন, "এটি আমাদের ভিন্নভাবে চিন্তা করতে শেখায়। পৃথিবী একটাই, আমাদের এটি রক্ষা করা উচিত।" তিনি আরও বলেন, পৃথিবী থেকে অনেক মানুষ তাদের বার্তা পাঠিয়েছেন, যা সবাইকে সংযুক্ত থাকার অনুভূতি দেয়।
মহাকাশ থেকে ভোট প্রদান
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বুচ, সুনিতা এবং আরও দুই আমেরিকান নভোচারী ডন পেটিট ও নিক হেগ মহাকাশ থেকে ভোট দিয়েছেন।
নাসা তাদের ভোট দেওয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করেছে। হিউস্টনের মিশন কন্ট্রোল সেন্টার তাদের কাছে এনক্রিপ্টেড ইমেলের মাধ্যমে ব্যালট পাঠায়। নভোচারীরা তা পূরণ করে উপগ্রহের মাধ্যমে নিউ মেক্সিকোর একটি গ্রাউন্ড টার্মিনালে পাঠান, সেখান থেকে এটি মিশন কন্ট্রোলে পৌঁছে এবং পরে সংশ্লিষ্ট কাউন্টি ক্লার্কের কাছে পাঠানো হয়।
শূন্য অভিকর্ষে শরীরচর্চা
বুচ প্রতিদিন ভোর ৪টা ৩০-এ এবং সুনিতা সকাল ৬টা ৩০-এ দিন শুরু করতেন। মহাকাশে থাকার ফলে শরীরের হাড় ও পেশির ক্ষয় রোধে তারা প্রতিদিন দুই ঘণ্টারও বেশি সময় শরীরচর্চা করতেন।
আইএসএস-এ তিন ধরনের শরীরচর্চার যন্ত্র রয়েছে—অ্যাডভান্সড রেসিস্টিভ এক্সারসাইজ ডিভাইস (যা স্কোয়াট, ডেডলিফট ও রো-এর জন্য ব্যবহৃত হয়), ট্রেডমিল (যেখানে বেল্টের সাহায্যে নভোচারীদের স্থির রাখা হয়), এবং সাইকেল আরগোমিটার যা ধৈর্য বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
বুচ বলেন, "শূন্য অভিকর্ষে শরীরচর্চার মজাই আলাদা, কারণ এতে শরীরের জয়েন্টে ব্যথা হয় না।"
ক্রিসমাস উদযাপন ও বিদায়বার্তা
আইএসএস-এ থাকা অবস্থায় নভোচারীরা উৎসাহের সঙ্গে ক্রিসমাস উদযাপন করেন। তারা সান্তা টুপি ও রেনডিয়ার হেডব্যান্ড পরে পৃথিবীর মানুষের উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠান। ক্যান্ডি ক্যান বাতাসে ভাসতে ভাসতে তারা একে অপরের কাছে মাইক্রোফোন ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন। সুনিতার লম্বা চুল শূন্য অভিকর্ষে ভেসে থাকায় তাকে দেখতে ব্যতিক্রম লাগছিল।
১৬ মার্চ স্পেসএক্সের একটি ক্যাপসুল নতুন ক্রু সদস্যদের নিয়ে আইএসএস-এ পৌঁছালে বুচ ও সুনিতার পৃথিবীতে ফেরার পথ উন্মুক্ত হয়। বুচ আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ঘণ্টা বাজিয়ে সুনিতার কাছ থেকে কমান্ড হস্তান্তর করেন রুশ নভোচারী আলেক্সেই ওভচিনিনের কাছে।
মহাকাশ থেকে ফিরে নতুন দিগন্ত
দীর্ঘ নয় মাস পর তারা পৃথিবীতে ফিরেছেন। তাদের এই মহাকাশযাত্রা শুধুমাত্র গবেষণার জন্যই নয়, বরং ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা হিসেবে বিবেচিত হবে।