বাংলা নববর্ষে প্রথমবারের মতো ড্রোন শো: শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা

 

First-ever drone show on Bengali New Year

বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর সন্ধ্যায় রাজধানী ঢাকার আকাশ আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে এক ব্যতিক্রমী আয়োজনের মাধ্যমে। প্রথমবারের মতো মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে অনুষ্ঠিত হলো ড্রোন শো—যা শুধু প্রযুক্তির প্রদর্শনীই ছিল না, বরং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, জাতীয় ইতিহাসের স্মরণ এবং বিশ্বমানবতার বার্তা বহন করে আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

সোমবার (১৪ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৭টায় জাতীয় সংসদ ভবনের আকাশে ২,৬০০ ড্রোনের মাধ্যমে এই ব্যতিক্রমী আয়োজন শুরু হয়। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে চলা শো'টি উপভোগ করেন লক্ষাধিক দর্শক, যারা রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ভিড় করেন।

স্বাধীনতা, প্রতিবাদ ও পুনর্জন্ম—আলোয় ভাসা বার্তাবহ আকাশচিত্র

ড্রোন শো’র সূচনা হয় একটি প্রতীকী দৃশ্য দিয়ে—হাতে ধরা একটি খাঁচাবন্দি পাখি। অন্ধকার আকাশে আলোর খেলা শুরু হয় সেই পাখির খাঁচা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দিয়ে। এরপর আকাশজুড়ে ভেসে ওঠে শব্দ: "Rebirth 36 July"। এই বার্তার মাধ্যমে ইঙ্গিত করা হয় ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত গণআন্দোলনের নবজাগরণের দিকে।

এরপর পরপর ভেসে ওঠে সেই আন্দোলনে শহীদ হওয়া তরুণ আবু সাঈদের হাত ছড়ানো ঐতিহাসিক প্রতিকৃতি এবং মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ’র ছবি—যেখানে তাকে পানি হাতে দেখা যায়, পাশে লেখা “পানি লাগবে পানি”। এই দুই তরুণের স্মরণে আকাশ স্তব্ধ হয়ে যায়। দর্শকদের চোখে তখন আবেগ ও শ্রদ্ধার ছাপ স্পষ্ট।

মানুষের সংগ্রাম ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে উঠে আসে আরও দৃশ্য

ড্রোনের আলোয় ভেসে ওঠে প্রতিবাদী এক নারীর অবয়ব—যা হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের সময় সাহসিকতার প্রতীক। তারপর দৃশ্যমান হয় আন্দোলনের সময় এক রিকশাচালকের স্যালুট জানানো ছবি—যা জনতার আত্মত্যাগ এবং অংশগ্রহণের প্রতিচ্ছবি।

এরপরই দেখা যায় বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা, যা শান্তি ও স্বপ্নের প্রতীক। এর মধ্য দিয়ে উৎসবে যুক্ত হয় একটি নান্দনিক ও আবেগঘন ধারা।

মুক্তিযুদ্ধ থেকে জুলাই বিপ্লব—ইতিহাসের ধারাবাহিকতা

ড্রোন শো’র পরবর্তী অংশে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে “১৯৭১” লেখা, যা কিছুক্ষণের মধ্যেই রূপ নেয় “২০২৪”-এ। নতুন বছরের প্রতীক হিসেবে এর ওপর দেখা যায় পতাকা হাতে এক ব্যক্তির অবয়ব—যেন এক নতুন আন্দোলনের বিজয়সূচক চিত্র।

আন্তর্জাতিক সংহতি ও শান্তির আহ্বান

শুধু দেশের ইতিহাস নয়, ড্রোন শো'তে জায়গা পায় বৈশ্বিক মানবিক সংকটের চিত্রও। ইসরায়েলি আগ্রাসনের শিকার ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে প্রদর্শিত হয় ফিলিস্তিনের পতাকা, শান্তির প্রতীক সাদা পায়রা এবং লেখা ভেসে ওঠে: “Prayers for Palestine”। আকাশজুড়ে ভেসে ওঠে এক শান্তির দূত এঞ্জেলের অবয়ব, যা উপস্থিত সবাইকে নীরব করে তোলে।

বাংলাদেশ-চীন মৈত্রীর প্রতীক

এই ব্যতিক্রমী আয়োজন বাস্তবায়নে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস। আয়োজকরা জানিয়েছেন, এটি চীন ও বাংলাদেশের মৈত্রীর একটি নিদর্শন হিসেবেই বিবেচিত হবে। ড্রোনের মাধ্যমে গঠিত হয় “Long Live China-Bangladesh Friendship” লেখা ও দুই দেশের পতাকা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দুই বন্ধুর অবয়ব।

শেষে নববর্ষের শুভেচ্ছা: প্রযুক্তিতে ছোঁয়া বাংলার ঐতিহ্য

ড্রোন শো’র শেষ পর্বে আকাশে বাংলায় ভেসে ওঠে: “শুভ নববর্ষ”। এই শুভেচ্ছা বার্তায় উৎসবের আনন্দ এবং জাতির ঐক্যের এক অভিন্ন বার্তা ফুটে ওঠে।

জনতার আবেগ ও আয়োজনের তাৎপর্য

এই আয়োজন শুধুমাত্র একটি প্রযুক্তিভিত্তিক শো নয়—এটি ছিল ইতিহাস, প্রতিবাদ, আবেগ, শিল্প ও আন্তর্জাতিক সংহতির এক সম্মিলিত রূপ। উপস্থিত দর্শকদের অনেকেই জানিয়েছেন, এই শো দেখে তাদের চোখে পানি এসে গেছে। কেউ বলছেন—‘এ যেন বাংলার আকাশে লেখা আমাদের আত্মপরিচয়ের কাব্য।’

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url