নববর্ষ ১৪৩২ উদযাপন: ঢাবি চারুকলায় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’

1432 bengali new year

বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এর সূচনায় ঢাকায় জমকালো আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে আয়োজিত এ শোভাযাত্রা ছিল রঙে, আনন্দে ও সংস্কৃতিতে ভরপুর এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। উৎসবমুখর পরিবেশে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণে মুখর হয়ে ওঠে গোটা এলাকা।

সকাল ৯টার দিকে চারুকলা প্রাঙ্গণ থেকে শোভাযাত্রার সূচনা হয়। এরপর এটি শাহবাগ মোড়, টিএসসি মোড়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের সড়ক ঘুরে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হয়।

নাম পরিবর্তনে আলোচনার ঝড়

বছরের পর বছর ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিত এই ঐতিহ্যবাহী আয়োজনটির নাম এবার পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। এই নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা প্রশ্ন ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই একে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধ্বংসের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন। তবে চারুকলার শিক্ষার্থীরা বলছেন, শোভাযাত্রার চেতনা ও মূল বার্তা ঠিকই অটুট আছে—নাম যাই হোক না কেন।

চারুকলা অনুষদের একাধিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, ‘শোভাযাত্রার মূল লক্ষ্য ছিল বর্ষবরণ এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক বার্তা তুলে ধরা।’ নাম পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও মানুষের অংশগ্রহণ, উৎসাহ ও উচ্ছ্বাসে কোনো ভাটা দেখা যায়নি।

শোভাযাত্রার থিম ও বার্তা

এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল: “নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান”। এতে রাজনৈতিক বার্তার পাশাপাশি উঠে এসেছে শান্তির আহ্বান ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ। ফিলিস্তিনের জনগণের প্রতি সংহতি এবং বাংলাদেশের জুলাই মাসের গণআন্দোলনের চেতনা এতে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় ছিল বিভিন্ন প্রতীকী শিল্পকর্ম ও মোটিফ। এর মধ্যে ছিল সাদা কবুতর—শান্তির প্রতীক হিসেবে। তবে সবচেয়ে আলোচিত মোটিফ ছিল ‘ফ্যাসিবাদের প্রতিকৃতি’, যেখানে শিল্পীদের শিল্পকর্মে ফুটে উঠেছে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখাবয়ব। এ অংশটি রাজনৈতিক বার্তার কারণে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করেছে।

সর্বজনীন অংশগ্রহণ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য

শোভাযাত্রায় অংশ নেয় দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা শিল্পী, শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষ, সাংস্কৃতিক কর্মী এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা। চাকমা, মারমা, সাঁওতাল ও গারো সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাকে অংশগ্রহণ করেন। এই বহুত্ববাদী অংশগ্রহণ নববর্ষের সর্বজনীনতা এবং জাতিগত বৈচিত্র্যের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

বিশেষভাবে চোখে পড়ে বাংলাদেশের জাতীয় নারী ফুটবল দলের সদস্যদের অংশগ্রহণ, যারা দেশের ঐক্য, গৌরব ও নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে এই শোভাযাত্রায় নিজেদের উপস্থিতি জানান দেন।

বাঙালির প্রাণের উৎসব

পহেলা বৈশাখ কেবল নতুন বছরের সূচনাই নয়, এটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের এক গর্বিত দিন। ধর্ম, গোত্র, ভাষা কিংবা রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে সব মানুষ এই দিন একত্রিত হয় আনন্দ উদযাপনে। এ উৎসব কেবল শহরে নয়, গ্রামীণ বাংলার প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে পড়ে। হালখাতা, মেলার আয়োজন, পান্তা-ইলিশ খাওয়া—সব মিলিয়ে এটি হয়ে ওঠে সম্প্রীতি ও ঐক্যের প্রতীক।


যদিও নাম পরিবর্তন ও প্রতিপাদ্য নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, ঢাবি চারুকলার শোভাযাত্রা নববর্ষ উদযাপনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। এ আয়োজন প্রমাণ করেছে—শিল্প, সংস্কৃতি ও মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই পারে একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে, সাহস দিতে, এবং এগিয়ে নিয়ে যেতে নতুন সম্ভাবনার পথে।



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url