সন্‌জীদা খাতুন: বাংলার সংস্কৃতির আলোকবর্তিকা

 

Sanjeeda Khatun
সন্‌জীদা খাতুন (৪ এপ্রিল ১৯৩৩ - ২৫ মার্চ ২০২৫)

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন আজ শূন্যতায় স্তব্ধ। ২৫ মার্চ ৩:১০ মিনিটে ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, রবীন্দ্রসংগীতের একনিষ্ঠ সাধক, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব সন্‌জীদা খাতুন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন।

এই সংবাদ শোনার পর এক অপূরণীয় শূন্যতা অনুভব করছি। যদিও তাঁর সঙ্গে সরাসরি ঘনিষ্ঠতা ছিল না, তবু তাঁর উপস্থিতি ছিল এক বিশাল ভরসা। তাঁর প্রস্থানে শুধু সংগীত বা শিক্ষা নয়, বাঙালির চেতনার এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তিনি ছিলেন এক আলোকবর্তিকা, যিনি জীবনভর সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রবীন্দ্রনাথকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।

শিক্ষাবিদ ও দৃষ্টিভঙ্গির পথপ্রদর্শক

সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সরাসরি ছাত্র হওয়ার। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে তাঁকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। তাঁর ক্লাসে বসে মনে হতো, বাংলা সাহিত্য শুধু বইয়ের বিষয় নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের অংশ। তিনি শেখাতেন, কেবল শব্দের অর্থ বোঝা নয়, বরং এর গভীরে প্রবেশ করা, সাহিত্যের সৌন্দর্য অনুধাবন করা। তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের পঙক্তিগুলো এক নতুন মাত্রা পেত—

"কেন দূরে থাকি, ওগো বন্ধু, কাছে আসি, কাছে।"

ছায়ানট ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ

১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনের মাধ্যমে ছায়ানটের যাত্রা শুরু হয়। সন্‌জীদা খাতুন ছিলেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণশক্তি। তাঁর নেতৃত্বেই বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সাংস্কৃতিক ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা আজ জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের সংস্কৃতির শেকড় উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল, তখনও তিনি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

স্বাধীনতার পরও তিনি সংস্কৃতির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে কাজ করে গেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, স্বাধীনতা শুধু ভৌগোলিক সীমানায় নয়, বরং ভাষা, সাহিত্য, সংগীত ও শিল্পের মধ্য দিয়ে জাতির প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ পায়। তাঁর দৃষ্টিতে সংস্কৃতি মানেই আত্মপরিচয়ের প্রতিচ্ছবি।

শিক্ষকতার অনন্যতা

তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন এক পথপ্রদর্শক। তাঁর পাঠদানে ছিল প্রাণের উচ্ছ্বাস, গভীর অন্তর্দৃষ্টি। তিনি চাইতেন, শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্রনাথকে শুধু মুখস্থ না করে, তাঁকে বুঝতে শিখুক। তিনি বলতেন, "কবিতা শুধু চিত্র নয়, এটি শব্দের ভিতরে গড়ে ওঠা এক অনুভবের ভাস্কর্য।"

তাঁর ক্লাসে বসে বাংলা সাহিত্যকে মনে হতো আমাদের জীবন, ইতিহাস ও অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। তিনি পাঠ্যবইয়ের বাইরেও আমাদের নজরুল, জীবনানন্দ কিংবা রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র পাঠ করাতেন।

রবীন্দ্রসংগীত ও মুক্তচিন্তা

সন্‌জীদা খাতুন রবীন্দ্রসংগীতকে কেবল সংগীত হিসেবে দেখেননি, বরং জীবনবোধ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি রবীন্দ্রসংগীতের মাধ্যমে বাঙালির মুক্তচিন্তা, সৌন্দর্যবোধ এবং আত্মজাগরণের পথ দেখিয়েছেন।

পাকিস্তান আমলে যখন রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা চলছিল, তখন তিনি সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। স্বাধীনতার পরও তিনি রবীন্দ্রসংগীতের প্রচারে কাজ করেছেন এবং সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন।

চিরকালীন অনুপ্রেরণা

সন্‌জীদা খাতুন কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর বিদায় একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি নয়, বরং একটি নতুন পথচলা। তাঁর শিক্ষা, আদর্শ ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের চিরকাল পথ দেখাবে।

আজও মনে পড়ে, তাঁর ক্লাসের সেই দিনগুলো, রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর কণ্ঠে শোনা, তাঁর চেহারায় সেই দৃঢ়তা। তিনি বলতেন, "সংস্কৃতি মানে কেবল গান বা কবিতা নয়, এটি জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি।"

আজ তিনি নেই, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে শোনা রবীন্দ্রসংগীত এখনো বাতাসে ভাসে—

"তবু মনে রেখো…"

আমরা আপনাকে চিরকাল মনে রাখব, সন্‌জীদা আপা।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url